( জাগো কুমিল্লা.কম)
আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার করে অপরাধের ঘটনা বাড়ছে। একের পর এক খুন, ছিনতাই, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি, অধিপত্য বিস্তার ও দখলবাজিতে অবৈধ অস্ত্র ব্যবহার করছে সন্ত্রাসীরা। বৈধ দোকানের বিপুল পরিমাণ অস্ত্রও চলে গেছে সন্ত্রাসীদের হাতে। পাহাড়ের সন্ত্রাসী, সুন্দরবনের দস্যু, জঙ্গিগোষ্ঠীর সদস্যদের হাতে রয়েছে অস্ত্র। রাজনৈতিক দলের ‘ক্যাডাররাও’ অস্ত্র মজুদ করেছে। রাজধানীতে খুন ও ছিনতাইয়ে অস্ত্রের ব্যবহার বাড়ার তথ্য মিলেছে। র্যাব-পুলিশ পাড়া-মহল্লায় অভিযান চালালেই মিলছে এসব অবৈধ অস্ত্র। পুলিশের পরিসংখ্যানে দেখা যাচ্ছে, অপরাধের হার কমলেও অস্ত্র উদ্ধার বেড়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন আসন্ন। এমন পরিস্থিতিতে এসব অস্ত্রধারী অপরাধীদের নিয়ে নতুন উৎকণ্ঠা তৈরি হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা গেছে, মাদকবিরোধী অভিযানের মতোই অস্ত্র উদ্ধারের অভিযান শুরু হতে যাচ্ছে। এরই মধ্যে ভারত থেকে পিস্তল-রিভলবার আনার ২৫টি চোরাপথ শনাক্ত করা হয়েছে। অবৈধ অস্ত্রধারীদের তালিকাও তৈরি করেছে গোয়েন্দারা।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, নির্বাচনের আগে দেশের আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের জন্য সারা দেশে অবৈধ অস্ত্রধারীদের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান শুরু হবে। ভারত থেকে ২৫টি রুট দিয়ে অবৈধভাবে আসছে পিস্তল-রিভলবার। মিয়ানমার হয়ে সে দেশের সীমান্তরক্ষী বাহিনীর সহায়তায় আসছে ভারী অস্ত্র। রুটগুলো চিহ্নিত হওয়ার পর কারবারি ও অস্ত্রধারীদের তথ্য সংগ্রহ করছে গোয়েন্দারা। এরই মধ্যে দুই শতাধিক ব্যক্তির নাম পাওয়া গেছে।
সূত্র মতে, এখন লাইসেন্স করা অনেক অস্ত্রও অপরাধের কাজে ভাড়া দেওয়া হচ্ছে। মাত্র পাঁচ হাজার থেকে ৩০ হাজার টাকায় ভাড়ায় মেলে পিস্তল-রিভলবার। অবৈধ অস্ত্রের গায়ের নম্বর টেম্পারিং বা ঘষাঘষি করে নিখুঁতভাবে বৈধ অস্ত্রের নম্বর বসিয়েও কৌশলে ব্যবহার করছে অপরাধীরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের এক কর্মকর্তা পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, একসময় শীর্ষ সন্ত্রাসী ও গডফাদারদের হাতে অস্ত্রের নিয়ন্ত্রণ ছিল। এখন রাজনৈতিক দলের ক্যাডার, জঙ্গি, পেশাদার সন্ত্রাসীরা অস্ত্র মজুদ করছে। অগ্নেয়াস্ত্র দিয়ে অপরাধ তারাই করে। অভিযানে এরাই ধরা পড়ে।
স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল গতকাল মঙ্গলবার বলেন, ‘অবৈধ অস্ত্রের বিরুদ্ধে আমাদের অভিযান চলমান আছে। পুলিশ, র্যাবসহ আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী রেইড দিয়ে অস্ত্র ধরছে। তবে সাম্প্রতিক ঘটনার কারণে অস্ত্রের ব্যবহারের বিষয়টি আমাদের নজরে এসেছে। অভিযান আরো জোরদার করা হবে।’
গত শুক্রবার ঈদের আগের দিন জুমার নামাজ পড়ে বাসায় ফেরার পথে গুলিতে নিহত হন বাড্ডা ইউনিয়ন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ফরহাদ আলী। অস্ত্রধারী দুই সন্ত্রাসী তাঁকে গুলি করে হত্যা করে। পুলিশ জানিয়েছে, সিসি ক্যামেরার ফুটেজ দেখে যে দুই ‘খুনি’কে শনাক্ত করা গেছে তাদের নাম জুয়েল ও মিরাজুল। অটোরিকশায় পালিয়ে যাওয়ার সময় গুলশান লিংক রোডে পুলিশের তল্লাশিচৌকিতে বাধার মুখে পড়ে খুনিরা। পুলিশ তল্লাশি করতে গেলে তাদের একজন ফাঁকা গুলি ছুড়ে অটোরিকশায় করে আবার পালিয়ে যায়। ডিশ ব্যবসা ও অধিপত্যের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে বিরোধের কারণে এই খুন হয়ে থাকতে পারে বলে সন্দেহ পুলিশের। একই ধরনের বিরোধে বাড্ডায়ই গত তিন মাসে আরো তিনজন খুন হয়। পাঁচ বছরে ওই থানা এলাকায় গুলি করে হত্যার
ঘটনা ঘটেছে ১৩টি। গত ৯ মে ডিশ ব্যবসায়ী আব্দুর রাজ্জাক ওরফে ডিশ বাবুকে গুলি করে হত্যা করে সন্ত্রাসীরা। গত ২২ এপ্রিল বেরাইদ ইউনিয়ন চেয়ারম্যানের ছোট ভাই কামরুজ্জামান দুখু এবং ১৮ ফেব্রুয়ারি মেরুল বাড্ডার মাছের আড়তে আবুল বাশার নামের এক সন্ত্রাসীকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১৫ সালের ১৩ আগস্ট রাতে বাড্ডার আদর্শনগরে গুলিতে নিহত হন ঢাকা মহানগর উত্তর স্বেচ্ছাসেবক লীগের সহ-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক সম্পাদক মাহবুবুর রহমান গামাসহ চারজন। ২০১৪ সালের ৩ মে বাড্ডা থানা ছাত্রলীগের সহসভাপতি মোফাজ্জল হোসেন রাহিনকে গুলি করে হত্যা করা হয়। ২০১২ সালের ২৯ ডিসেম্বর দিনদুপুরে গুলি ও বোমা ছুড়ে হত্যা করা হয় স্বেচ্ছাসেবক লীগ নেতা মামুনকে। একইভাবে খুন হন সাইদুর, মাসুম, আলা, রুবেল ও তাইজুলসহ কয়েকজন। কয়েক মাস আগে বনানীতে জনশক্তি রপ্তানি ব্যবসায়ী এস সিদ্দিকের অফিসে ঢুকে তাঁকে গুলি করে হত্যা করে ছয় সন্ত্রাসী।
এবার ঈদের ছুটিতে (শুক্র, শনি ও রবিবার) আগ্নেয়াস্ত্রের গর্জনে কেঁপে উঠেছে পার্বত্য চট্টগ্রাম। রাঙামাটিতে পার্বত্য চট্টগ্রাম জনসংহতি সমিতির (এম এন লারমা) এক সদস্য ও এক সাবেক কর্মী এবং খাগড়াছড়িতে সংগঠনটির এক সদস্যকে গুলি করে হত্যা করেছে দুর্বৃত্তরা। এসব হত্যাকাণ্ডের জন্য ইউপিডিএফকে দায়ী করছে জনসংহতি সমিতি (এম এন লারমা)।
রমজানে ও ঈদে রাজধানীর আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি আগের বছরগুলোর চেয়ে ভালো ছিল বলে দাবি করছেন ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।
এই পরিস্থিতির মধ্যেই ১০ জুন দিনদুপুরে ডেমরার পূর্ব বক্সনগর এলাকায় ছিনতাইকারীর গুলিতে নিহত হন বিকাশের কর্মী রাশেদুল। ৯ জুন সবুজবাগে ছিনতাইকারীর ছুরিকাঘাতে প্রাণ হারায় রাহাত মিয়া সুজন নামের এক তরুণ। ঈদের ছুটির মধ্যে ছিনতাইকারীরা আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠে। তবে সহিংসতা বা প্রাণহানির ঘটনা না ঘটায় পুলিশের খাতায় নথিভুক্ত হয়নি এসব ছিনতাই। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মিরপুর, মতিঝিল, গুলিস্তান, সায়েদাবাদ, ধানমণ্ডি, মোহাম্মদপুর ও উত্তরা এলাকায় ঈদের ছুটিতে অস্ত্র ঠেকিয়ে ছিনতাইয়ের বেশ কিছু ঘটনা ঘটেছে। ঈদে ঘরমুখো মানুষ সব খুইয়েও পুলিশের দ্বারস্থ হননি। ঈদের সময় ঢিলেঢালা টহলের সুযোগ নিয়েছে ছিনতাইকারীরা। গত ১৪ জুন রাতে ধানমণ্ডির ২৭ নম্বর থেকে রিকশায় করে লালমাটিয়ার বাসায় যাওয়ার সময় ছিনতাইকারীদের কবলে পড়েন কালের কণ্ঠ’র উপপ্রধান প্রতিবেদক তৌফিক মারুফ। ছিনতাইকারীরা অস্ত্র ঠেকিয়ে তাঁর কাছ থেকে ৪২ হাজার টাকা ও দুটি মোবাইল ফোনসেট ছিনিয়ে নিয়ে যায়। স্থানীয় লোকজন বলছে, ওই সড়কে ভদ্রবেশে ঘুরে ছিনতাই করার কয়েকটি ঘটনা ঘটেছে। পথচারীদের সঙ্গে বা বহনকারী রিকশার সঙ্গে ধাক্কা খেয়ে পথ আগলে অস্ত্র ঠেকায় দুর্বৃত্তরা।
গত বৃহস্পতিবার ভোরে ধানমণ্ডির সীমান্ত স্কয়ারের কাছে জার্মান তরুণী সুইন্ডে উইদারহোল্ডের ল্যাপটপের ব্যাগ টেনে নিয়ে যায় একটি সাদা প্রাইভেট কারে থাকা ছিনতাইকারীর দল। সুইন্ডে ধানমণ্ডির পাঠশালা সাউথ এশিয়ান মিডিয়া ইনস্টিটিউটের ফটোগ্রাফি কোর্সের শিক্ষার্থী। জামার্নি থেকে ফটোগ্রাফি শিখতে ঢাকায় এসে প্রচুর ছবি তুলেছেন তিনি। সেসব ছবি হারিয়ে গত শুক্রবার কেঁদে দেশ ছাড়েন সুইন্ডে। এর আগে ধানমণ্ডি থানায় একটি মামলা করে যান তিনি। ধানমণ্ডি থানার পরিদর্শক (তদন্ত) পারভেজ ইসলাম বলেন, গোটা এলাকায় টহল আছে। ওই ঘটনায় কারা জড়িত, তা বের করার চেষ্টা চলছে।
এদিকে সম্প্রতি অস্ত্রসহ কয়েকজন জঙ্গি ধরা পড়েছে। ডিএমপির কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অভিযানে বৈধ অস্ত্রের অবৈধ কারবারের তথ্যও উঠে এসেছে। গত ১১ জুন মুন্সীগঞ্জের সিরাজদিখানে ঢাকার বিশাকা প্রকাশনীর স্বত্বাধিকারী, লেখক-ব্লগার শাহজাহান বাচ্চুকে গুলি করে হত্যা করে মোটরসাইকেলে পালিয়ে গেছে চার দুর্বৃত্ত। ঘটনার আলামত বিশ্লেষণ করে সিটিটিসি ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম বলেন, আনসার আল ইসলামের (সাবেক এবিটি) জঙ্গিরা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়ে থাকতে পারে বলে ধারণা করা হচ্ছে। আগে সংগঠনটি ধারালো অস্ত্র ব্যবহার করেই হত্যা করত। এখন তারা আগ্নেয়াস্ত্র ব্যবহার শুরু করেছে।
পুলিশের এ ইউনিটের অভিযানে গত ১১ জুন রাজধানীর মহাখালীতে অভিযান চালিয়ে ১০টি আগ্নেয়াস্ত্র ও এক হাজার ১৮৫ রাউন্ড গুলিসহ মোহাম্মদ আলী বাবুল নামের এক অস্ত্র ব্যবসায়ীকে গ্রেপ্তার করা হয়। নেত্রকোনার ‘মেসার্স নেত্রকোনা আর্মস’-এর স্বত্বাধিকারী বাবুলকে গ্রেপ্তার করার পর জানা গেছে, বৈধ অস্ত্রের দোকানের বিপুল পরিমাণ অস্ত্র চলে গেছে সন্ত্রাসীদের হাতে। গত ১৫ মে যাত্রাবাড়ী এলাকা থেকে ডা. জাহিদুল আলম কাদিরকে এবং তাঁর স্ত্রী মাসুমা আক্তারকে গাবতলী এলাকা থেকে অস্ত্র-গুলিসহ গ্রেপ্তার করা হয়। ময়মনসিংহে জাহিদুল আলম কাদিরের বাসা থেকে উদ্ধার করা হয় বেশ কিছু অস্ত্র-গুলি। জিজ্ঞাসাবাদে আরো কয়েকজন বৈধ অস্ত্র ব্যবসায়ীর অবৈধ অস্ত্র ব্যবসায় জড়িত থাকার বিষয়টি উঠে আসে। মনিরুল ইসলাম বলেন, ‘অস্ত্র ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী বাবুল, আগ্নেয়াস্ত্রের বৈধ ডিলারশিপ থাকলেও অধিক মুনাফার লোভে দীর্ঘদিন ধরে সে অবৈধ পন্থায় অস্ত্র কেনাবেচা করে আসছিল।’
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা যায়, ২০১৭ সালে সারা দেশে সাড়ে পাঁচ হাজার অস্ত্র উদ্ধার করা হয়েছিল। এসব অস্ত্র উদ্ধারের ঘটনায় মামলা হয়েছিল দুই হাজার ২০৮টি, যার বেশির ভাগই বিচারাধীন। অনেক মামলার আসামিও ধরা পড়েনি। সূত্র: কালের কণ্ঠ
Leave a Reply