অনলাইন ডেস্ক:
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৮-১৯ শিক্ষাবর্ষের এক ভর্তিচ্ছুর সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের ত্রাণ ও দূর্যোগ বিষয়ক সম্পাদক তারেক আহমেদ খান শান্তর মোবাইলে কথাপোকথনের রেকর্ডিং ফাঁস হয়েছে। এ নিয়ে তোলপাড় শুরু হয়েছে ক্যাম্পাসে। নড়েচড়ে বসেছে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন।
‘শান্ত ভাইয়া, আমি এবার সেকেন্ড টাইম পরীক্ষা দিচ্ছি। আমার রেজাল্টও খারাপ। বাসা থেকে চাপ দিচ্ছে, যে করেই হোক পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ে চান্স পেতেই হবে। যত টাকা লাগে দেব।’ তখন ফোনের ওপাশ থেকে বলতে শোনা যায়, ‘তুমি কোন ইউনিটে ফরম তুলেছো? আমাদের কিছু সিস্টেম আছে। ঢাকা থেকে এসে তোমার পরীক্ষা দিয়ে যাবে। সায়েন্সে একটু সমস্যা, কিন্তু আর্টসে (মানবিক) কাজ করা যাবে। তিন লাখ টাকা লাগবে।’
তখন ভর্তিচ্ছুকে বলতে শোনা যায়, ‘একটু কনসিডার করেন ভাইয়া।’ এরপর ছাত্রলীগ নেতা শান্ত বলেন, ‘ভাই, আমাদের সিস্টেম হচ্ছে প্রক্সি। এখানে ঢাকা থেকে এক্সপার্ট এসে পরীক্ষা দিয়ে যায়। তাদেরকে দিতে হয় দেড় থেকে দুই লাখ টাকা। একটি সিন্ডিকেট আছে, তাদেরও টাকা দিতে হয়। তারপর আমাদের জন্য খুব একটা বেশি লাভ থাকে না। ঠিক আছে তুমি যেহেতু বলছো- তোমার জন্য আড়াই লাখ করে দিতে পারবো। এর কম হবে না।’
রেকর্ডিংয়ের একপর্যায়ে ওই ভর্তিচ্ছুকে বলতে শোনা যায়, ‘গত বছর আমার পরিচিত এক বড় ভাই আপনাদের মাধ্যমে ভর্তি হয়েছিল। এ বছর যে করেই হোক আমাকে ভর্তি হতে হবে।’ তখন এই ছাত্রলীগ নেতা জবাব দেন, ‘ঠিক আছে, মেরিট লিস্টে নাম আসার পর তোমাকে টাকা দিতে হবে। এর আগে পাঁচ হাজারের মতো টাকা দেওয়া লাগতে পারে। এক্সপার্টরা (প্রক্সিদাতা) ঢাকা থেকে আসে তো, ওদের জন্য কিছু টাকা লাগে।’ রেকর্ডিং অনুযায়ী দর-কষাকষির একপর্যায়ে তাঁদের মধ্যে আড়াই লাখ টাকায় ভর্তি করার চুক্তি হয়।
ফোন রেকর্ডিংয়ের বিষয়টি স্বীকার করেছেন ছাত্রলীগ নেতা তারেক আহমেদ খান শান্ত। তিনি বলেন, ‘আমার কাছে একটা ফোন এসেছিল। এরপর থেকে ওই ফোন নম্বর বন্ধ। পূর্বশত্রুতার জের ধরে রাবি ছাত্রলীগের সহ-সম্পাদক হাসিবুল হাসান শান্ত ও উপ-প্রশিক্ষণ বিষয়ক সম্পাদক কাউসার আমাকে ফাঁসানোর চেষ্টা করছে বলে মনে হচ্ছে।’
তবে এ বিষয়ে কাউসার ইসলাম বলেন, ‘তারেক আহমেদ খান শান্তকে আমি কেন ফাঁসাতে যাবো। সে আমার দলের নেতা। তার সঙ্গে আমার কোনো বিরোধ নেই। বিষয়টি হাস্যকর।’
অনুসন্ধানে জানা গেছে, ভর্তি পরীক্ষা কেন্দ্র করে যারা জালিয়াতি চক্রে কাজ করছেন, তাদের অধিকাংশই ছাত্রলীগের রাজনীতিতে জড়িত। বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের ৩ জন সহ-সভাপতি ও ১ জন যুগ্ম-সাধারণ সম্পাদক, ২ জন সাংগঠনিক সম্পাদক এ কাজে সরাসরি কাজ করছে। ভর্তি পরীক্ষার প্রবেশপত্রে পরীক্ষার্থী ও প্রক্সিদাতার ছবিতে কারসাজি এবং যেকোনো উপায়ে ভর্তি পরীক্ষার প্রশ্ন সংগ্রহের পর সমাধান করে তা ডিজিটাল ডিভাইসের মাধ্যমে পরীক্ষার্থীর কাছে পাঠানোর মাধ্যমে এই জালিয়াতির ছক আঁকছেন তারা। বিশ্ববিদ্যালয়ের কাজলা গেটে ছাত্রলীগ নিয়ন্ত্রিত একটি কোচিং সেন্টার থেকে ভর্তি জালিয়াতি সংক্রান্ত বিভিন্ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে বলেও জানিয়েছে খোদ আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এ ছাড়াও বিশ্ববিদ্যালয় সংলগ্ন কাটাখালি এলাকায় স্থানীয় একটি প্রতারক চক্র প্রতিবছরই গোপনে ভর্তি পরীক্ষার নাম করে ভুয়া প্রশ্নপত্র বিক্রির কাজ করে। স্থানীয় রাজনীতিবিদদের সঙ্গে লিঁয়াজো করে চক্রটি এ কাজ করছে।
রাবি ছাত্রলীগের প্রথম সারির কয়েকজন নেতা নাম-পরিচয় প্রকাশ না করার শর্তে জানান, ‘প্রতিবছরই ছাত্রলীগের বেশ কিছু নেতা এসব ভর্তি বাণিজ্য করে থাকে। সংগঠনের কর্মীরা ভর্তীচ্ছু সংগ্রহ করেন। এরপর টাকা মিটিয়ে ভর্তীচ্ছুদের রেজিস্ট্রেশন কার্ড বা মার্কশিট রেখে দেন তারা। পরীক্ষার এক ঘণ্টা আগে বিশ্ববিদ্যালয়ের যেকোনো একটি আবাসিক হলের কক্ষে ভর্তীচ্ছুদের একসঙ্গে বসিয়ে উত্তরপত্রসহ প্রশ্ন সরবরাহ কিংবা প্রক্সির মাধ্যমে জালিয়াতি সম্পন্ন করেন ছাত্রলীগের এই নেতারা। কিন্তু অজ্ঞাত কারণে এসব জেনেও নিশ্চুপ থাকেন বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক। নিশ্চয় তাদের এখানে কোনো বেনিফিট রয়েছে জানান তারা।’
ভর্তি জালিয়াতির এসব ঘটনা নতুন নয় রাবি ছাত্রলীগের। গত বছর ১৮ জুলাই পরীক্ষায় প্রক্সি দিতে গিয়ে রাজশাহী মোহনপুর ডিগ্রি কলেজ কেন্দ্র থেকে বান্ধবীসহ গ্রেপ্তার হন রাবি ছাত্রলীগের বর্তমান কমিটির যুগ্ম-সম্পাদক মো. সাব্বির হোসেন। গত ১৭ ডিসেম্বর বেগম রোকেয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের ২০১৭-১৮ শিক্ষাবর্ষের ভর্তি পরীক্ষায় জালিয়াতির ঘটনায় রাবি ছাত্রলীগের যুগ্ম-সম্পাদক মেহেদি হাসান সজল ও ছাত্রলীগ কর্মী মোস্তফা বিন ইসমাইলকে আটক করে পুলিশ।
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সাধারণ সম্পাদক ফয়সাল আহমেদ রুনু বলেন, ‘আমাদের কোন নেতাকর্মী এসব কাজের সঙ্গে জড়িত কিনা আমার জানা নেই। ছাত্রলীগের নাম ভাঙিয়ে কোন নেতাকর্মীর এসব কাজের সঙ্গে সম্পৃক্ততা পেলে আমরা অবশ্যই ব্যবস্থা নেবো।’
জানতে চাইলে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রক্টর অধ্যাপক লুৎফর রহমান বলেন, ভর্তি পরীক্ষায় কঠোর নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হবে। যেকোনো ধরনের জালিয়াতি ঠেকাতে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সদা তৎপর থাকবে। পত্র-পত্রিকায় যেসব তথ্য প্রকাশ হয়েছে, তা নিয়ে আজ (১৪ অক্টোবর) বিশ্ববিদ্যালয়ের উর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে মিটিং আছে। সেখানে এ বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা হবে।’
https://www.facebook.com/purboposhchimbd.news/videos/243932416277807/
Leave a Reply